Gloomy Sunday

8:52 AM



#এক [ ১৯৭২  ডিসেম্বেরের এক সন্ধ্যা ]
-     সময়টা তখন ছিল, ১৯৩৬ ফেব্রুয়ারী, মানে যতদূর আমার মনে পড়ে আর কি, বললেন মিঃ রুথ ।।
-     ধুর ও আবার হয় নাকি, যতসব আষাঢ়ে গল্প, হাতের পাইপটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন মিঃ স্মিথ।
ইংল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রাম Clovelly, রোজকার মত মিঃ রুথের বাড়িতে সন্ধ্যাকালীন আড্ডা বসেছে, আজকের বিষয় Cursed Objects ।।
-     বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা ? দাঁড়াও আমি সব পেপার কাট আউট জমা করে রাখি, এনে তোমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারব, হন্তদন্ত হয়ে স্টাডি রুমের দিকে চলে গেলেন রুথ।
-     যত বয়স বাড়ছে, দিন দিন ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে বুড়ো রুথ,ফুট কাটলেন ঘরের কোনায় বসে থাকা মিঃ রবিন।
বাদ-বাকীরাও ঘর ফাটিয়ে  হাসিতে যোগদান করল ।।
-     অশিক্ষিতের দল যতসব, এই দেখো , জেনে রেখো আর যাই হোক, বুড়ো রুথ কখনও মিথ্যা কথা বলেনা, ফিরে এলেন  রুথ হাতে একতাড়া পুরানো পেপার কাট আউট নিয়ে, এক এক করে পড়ে চললেন সে গুলো......
-     This Song's a Killer: The Strange Tale of "Gloomy Sunday"
হ্যাঁ, ওই যেটা বলছিলাম, ১৯৩৬ ফেব্রুয়ারী বুদাপেস্টের পুলিশ, এক মুচীর আত্মহত্যার কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক অদ্ভুত জিনিসের সম্মুখীন হয়।
-     কি অদ্ভুত জিনিষ ?
-     তার সুইসাইড নোটটা, তাতে মৃত্যুর কোনও কারন লেখা ছিল না, ছিল ওই গানটার লিরিক্স লেখা ।।
-     হু, এটা মাত্র একটা ঘটনা , এটা দিয়ে কিসসু প্রমান হয়না
-     তুমি কথা থামাবে? নাকি তোমাকে ঘাড় ধরে বাইরের তুষারঝড়ে বের করে দেবো ?
একটা ঝগড়া বাঁধতে যাচ্ছিলো, সবাই মিলে অনেক কষ্টে সামাল দেয়,  রুথ বলে চলেন আবার .........
-     ভিয়েনাতে একটা কুমারী মেয়ে, নিজেকে ডুবিয়ে মেরে ফেলে জানো, জলের মধ্যে তার লাশ ছাড়া, আর যে জিনিষটা ভাসতে দেখা গেছিলো সেটা হল ওই গানটার একটা মিউজিক সীট। আর কত বলব, প্রায় ১০০ এর ওপরে মানুষ নিজেকে শেষ করে দিয়েছে এবং প্রত্যেকের সাথেই, এই গানটা কোনোভাবে জড়িয়ে গেছে
-     আরও কিছু ঘটনার প্রমান দাও ।
-     বেশ এটা হল  ১৯৪০ এর দিকের ঘটনা, এক ভদ্রলোক বারে গিয়ে ব্যান্ডকে অনুরোধ করেছিলেন, গানটা গাইতে, গান শুনে খুশী হয়ে তিনি তাদের একগাদা টীপও দেন, বাড়ি ফিরে গিয়ে শোনা যায়, তিনি নিজের হাতে নিজের মাথায় গুলি করেন
-     হুম বুঝলাম।
-     আরও শুনবে? শোনও তাহলে এই আমাদের লন্ডনেই ছিলেন এক মহিলা, নিজের গ্রামোফোন চালিয়ে রেখে আত্মহত্যা করেন, পরে পুলিশ যখন গিয়ে দরজা ভাঙ্গে, তারা কি দেখতে পায় জানো ? তখন সেই এই গানটাই বাজছিল, এত গুলো ঘটনা নিশ্চই কাকতালীও হতে পারেনা তাইনা ?
-     কোন গানটার কথা বলা হচ্ছে এখানে?
হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজে ঘরের পরিবেশটা পালটে যায়, দরজা খুলে ঢোকেন মিস্টার কার্ল, গিবসন কার্ল, স্থানীয় শেরিফ ।
-     এই যে রুথ এক গেজুড়ে গপ্প শোনাচ্ছিল বুঝলেন, কি নাকি একটা গান, এত Depressing , মানুষ শুনলেই নাকি আত্মহত্যা করত, আবার ফুট কাটলেন রবিন।।
-     এতগুলো পরিসংখ্যান দেওয়ার পরেও উজবুক গিরি, জানো পুলিশ এই গানটা ব্যান করেছিলো, কোনও পাবলিক প্লেস কিম্বা রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদিতে, কাণ্ডজ্ঞান হীন মর্কট একটা, আমি বানিয়ে বলছি ? খেপে উঠলেন রুথ ।
-     আহা কোন গানটা, সেটাতো বল অন্তত আমাকে,শুনেই দেখি, দিয়ে নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করব না হয়, সামাল দেন মিঃ কার্ল ।
-      ও হ্যা, তুমি তো দেরী করে এসেছ, এদের বলেছিলাম অবশ্য , তবে সবই অপাত্রে দান হয়ে গেছে বুঝতে পারছি, তুমিই শোন ভায়া ............হাত পা নেড়ে তীব্র উত্তেজিত হয়ে পুনরায় গল্প শুরু করলেন রুথ
বাইরের তুষারপাতের পরিমানটা  বাড়তে থাকে , আজ রাতটা বেশ দীর্ঘ আর ঠাণ্ডা হতে চলেছে বোঝা যায় ...............।।





#দুই [ ১৯৬৮ হাঙ্গেরির,বুদাপেস্ট ]
নিজের এপার্টমেণ্টের জানলা দিয়ে অস্তগামী সূর্যটাকে দেখছিলেন Rezso Seress , দেখছিলেন আশ পাশটা কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, পাখীরা সব ঘরে ফিরে চলেছে।
 তিনিও তো ফিরতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন নাৎসি ক্যাম্পের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, প্রতি মুহূর্তে নিজের প্রেয়সীর মুখ মনে করে যন্ত্রণা ভুলে থাকতে, তারপরে সত্যিই যেদিন তিনি ফিরে গেলেন তার কাছে, দেখলেন সে আর নেই, সময় কেড়ে নিয়েছে তাকে।
তিনি তো চেয়েছিলেন আগের মত করে আবার একটা গান বাঁধতে, যেটা আগেরটার জনপ্রিয়তা কে হারিয়ে দেবে, অনেক অনেক চেষ্টা করেছেন, দিনের পর দিন ,রাতের পর রাত, শব্দের পর শব্দ, কিন্তু না , আবর্জনার স্তুপ ছাড়া সেগুলো আর কিচ্ছু বাড়ায়নি,ক্লান্ত হয়ে গেছেন তিনি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে।
সূর্যের পড়ন্ত আলোয়,নিজের ছায়ার দিকে খেয়াল করলেন তিনি, তার অবয়বের থেকে আজ ছায়াটা অনেক বড়, বুঝলেন অস্ত যাবার সময় এসে গেছে।
তবে তাই হোক, শেষ হোক এ যন্ত্রণার, গানটার যে বদনাম আছে, তাকেই আরও সত্যতা দেওয়া যাক,উঠে পড়লেন তিনি গরাদবিহীন জানলাটায়।
 শেষ একবার নিজের প্রেয়সীর মুখটা মনে করার চেষ্টা করলেন, কেমন সব ঝাপসা হয়ে আসছে,শুধু যেটা স্পষ্ট হয়ে আছে সেটা হল প্রেয়সীর হাতে ধরা সেই কাগজটা, যেখানে নড়বড়ে হাতে লেখা “Gloomy Sunday” …… ।।
 হঠাৎ করে বিকট একটা শব্দ হল, কে জানি ১০ তলা থেকে লাফিয়ে পড়েছে নীচে, মুহূর্তে রাস্তায় ভিড় জমে গেলো, একটা নিথর দেহ,তার থেকে ছলকে বেরিয়ে আসছে রক্ত, ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশটা......।।


#তিন [ ১৯৭২  ডিসেম্বেরের এক রাত ]
হ্যাঁ রক্ত, প্রচুর রক্ত লেগে আছে শাবলটায়, একটা কাপড় আর জল দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে।
উফফ কি মর্মান্তিক সেই চিৎকার, শাবলটা ছুঁড়ে ফেলে নিজের কান দুটো রক্তমাখা হাতেই চেপে ধরলেন মিস্টার কার্ল, গিবসন কার্ল, স্থানীয় শেরিফ ।
মৃতুযন্ত্রণার চিৎকার বুঝি এরকমই হয়, তিনি আর পারলেন না, টলতে টলতে উঠে গ্রামোফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন, চালিয়ে দিলেন সশব্দে হাতের কাছে যে রেকর্ডটা পেলেন
 কিছুক্ষন পর খেয়াল করলেন তিনি,যে রেকর্ডটা বাজছে সেটা হল, সেইদিন সন্ধ্যায় বুড়ো রুথের কাছে ধার করে আনা সেই হাঙ্গেরিয়ান কবির গান, Gloomy Sunday  ......।।
আসলে, তাঁর মত বিচক্ষন  একজন মানুষও যে  এই কাজ করে ফেলবে,এটা এখনও তাঁর বিশ্বাস হচ্ছেনা, কিন্তু পাশে পড়ে থাকা লাশদুটো যে এখনও গরম।
আসলে বেশী রাত করে বাড়ি ফিরে,আচমকা  তাঁর বিছানায় সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আলিঙ্গনবদ্ধ দুটো শরীর দেখে তাঁর আর মাথার ঠিক ছিলোনা,তাই নীচ থেকে শাবলটা এনে আঘাতের পর আঘাত হেনে তাদের চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিতে তিনি দুবার ভাবেন নি।
ওদের শাস্তি ওরা পেয়েছে, ওরা মানে তাঁর স্ত্রী আর তাঁর নিগ্রো চাকরটা।
কিন্তু তাঁর কি হবে, সারাজীবন যে তিনি সত্যের পথে চলেছেন, শেরিফ হিসাবে সর্বদা,অন্যায়ের শাস্তি দিয়ে ন্যায়ের বিচার করেছেন, কাল লোকে যখন জানবে, শেরিফ কার্ল নিজেই এক চরম অন্যায় কাজ করেছে, তাদের দৃষ্টি তিনি সহ্য করতে পারবেন না, তার থেকে বরং......।।
 
   
- তারপর? আহা থেমে গেলেন কেন,তারপর কি হল প্রফেসর?
- ধীরে ভায়া ধীরে অত হড়বড় করলে গপ্প বলার মজা থাকে নাকি , একটু রেস্ট।
শনিবার সন্ধ্যে হতে না হতেই, দৌড় মেরেছিলাম প্রফেসর সোমের বাড়ি আড্ডা মারতে, এতক্ষন প্রফেসর বলে চলেছিলেন Gloomy Sunday  নিয়ে এই কাহিনী।
- সে নাহয় আপনি রেস্ট নিন, Just এটা বলে যান, যে শেরিফ কার্লের কি হল? আর এই Gloomy Sunday  এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি?
- সব বলব, তার আগে এক কাপ কড়া করে কফি বলে আসি।।

#চার
- আমি তখন Devon এ একটা চার্চে কাজ করি বুঝলে, শুধু ধর্মীয় উপাসনার নিয়মকানুনই নয়,কিভাবে শয়তানকে বশে আনা যায়,যাতে সে মানুষের মধ্যে অবাধ বিচরণ না করতে পারে কিম্বা যে সমস্ত ডেমন অলরেডি উপস্থিত আছে মানুষের মধ্যে তাদের বশে আনার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রনালীর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিল আমাকে,যাইহোক সেইসব ডিটেলসে বলে আর বিরক্ত করবোনা তোমাকে, বললেন প্রফেসর সোম।
- কিন্তু Gloomy Sunday এর সাথে আপনার সম্পর্কটা এখনও ঠিক পরিষ্কার হলোনা যে, আমি প্রশ্ন করলাম।
- বলছি ভায়া বলছি, একদিন বুঝলে ফাদার জোসেফের অফিস থেকে আমার তলব এলো,গেলাম, গিয়ে দেখি এক রাশভারী বয়স্ক লোক বসে আছেন।
ফাদার আলাপ করিয়ে দিলেন।
- এসো সোম, আলাপ করিয়ে দি, ইনি হলেন মিঃ ডিয়োগো থমাস,Clovely এর বর্তমান শেরিফ, উনি একটা সমস্যায় পড়ে আমাদের কাছে এসেছেন, তো আমি চাইছি, তুমি এটা Handle করো, শিক্ষানবিশ হিসাবে এটা তোমার প্রথম Assignment , বললেন ফাদার জোসেফ।
- এরপরেই মিঃ থমাস, সবটা বললেন আমাকে Gloomy Sunday থেকে শুরু করে আগের শেরিফের নিজের হাতে প্রথমে স্ত্রীকে খুন ও পরে নিজের আত্মহত্যা সবটাই, এবারে বুঝলে তো কৌশিক, প্রশ্ন করলেন প্রফেসর।
আমি মাথা নাড়লাম,প্রফেসর কে ঘুরে প্রশ্ন করলাম , কিন্তু মিঃ থমাস কি সমস্যা নিয়ে এসছিলেন?
- সমস্যাটা একটু অদ্ভুত বুঝলে, সেই আগের শেরিফের ওরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর,সাধারণ জনবসতি থেকে একটু দূরে,টিলার ওপর ওনার বাড়িটা বহুবছর বন্ধই ছিল, কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু হঠাৎ একদিন কয়েকটা ছেলের প্রানবিহীন শরীর বাড়িটার সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায়,সারা গ্রামে হইচই পড়ে যায়। যদিও ছেলেগুলো ভালো ছিলোনা, সারাদিন মদ-জুয়া এসব করে বেড়াত, এবং সেই কারনেই হয়ত লুকিয়ে ঐ বন্ধ বাড়িতে ঢুকেছিল, কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনওকারনেই সমর্থনযোগ্য নয়,তাই শেরিফ হিসাবে থমাসের ঘাড়ে এই ঘটনার তদন্তের ভার পড়ে, কিন্তু আসল সমস্যাটা ঘটে অন্য জায়গায়।
- কি সমস্যা?
- আসলে তিনি নিজে টীম নিয়ে সরজমিনে তদন্ত করতে ঢুকেছিলেন বাড়ীটায়, একগাদা অতীতের জমে থাকা ধূলোর আস্তরণ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা, কোনও অস্বাভাবিকতাই তাঁর চোখে পড়েনি। তদন্তের কোনও সুরাহাই হচ্ছেনা দেখে তিনি এক স্থানীয় জুনিয়র অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, বাড়িটার ওপর নজর রাখার।
- তারপর?
- তারপরই তো আসল ঘটনাটা ঘটে যায়, সেই অফিসার নাকি দুম করে নিখোঁজ হয়ে যান, শেরিফ থমাসের মনে সন্দেহ জাগে, এবং তিনি সেই বন্ধ বাড়িটা আবার খুঁজতে যান, এবং যেঁটা আশঙ্কা করেছিলেন ঠিক তাই, বন্ধ ঘরের দোতলার মেঝেতে সেই অফিসারের লাশ,তবে এবারেরটা খুন নয়,নিজের সার্ভিস রিভলবারের গুলিতেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন লাশের মগজটা।
শেরিফ থমাস একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ, স্থানীয় লোকগাথায় তিনি বিশ্বাসও করেন না,কিন্তু পরপর ঘটনাগুলোর কোনও কার্য্য কারন তিনি খুঁজে পাননি, আর শেষে তাই একান্ত নিরুপায় হয়েই লোকাল চার্চের পাদ্রীর কথায় উনি আমাদের কাছে এসেছিলেন যদি আমরা কিছু আলোকপাত করতে পারিযাইহোক, আমি শেষপর্যন্ত শেরিফের সাথে Clovely এর দিকে রওনা হয়ে গেলাম, ওনারই আনা ঘোড়ার গাড়িতে সঙ্গে নিলাম আমার এক বিশেষ টুল বক্স যেটা চার্চ থেকে আমাদের সবাইকে দেওয়া হয়েছিল,বেরবার সময় ফাদার জোসেফ আমাদের সবার মাথায় পবিত্র জল ছিটিয়ে পরমপিতার কাছে আমাদের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করেন আর বলেন, “সোম, শুধু এই কথাটা মাথায় রেখো, ভয় না পেলে বিশ্বের কোনও শক্তির ক্ষমতা নেই সে মানুষকে হারায়, শুধু ভয় পাবেনা কিছুতেই”  
যাইহোক, Clovely তে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেলো,শেরিফ থমাসের পরিবার খুব Friendly দেখলাম, সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন আমার ওনার বন্ধুর ছেলে হিসাবে এখানে জমি দেখতে এসছি,যদিও আগেই আমাকে শেরিফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে যাতে কোনওভাবে কাক-পক্ষীতে টের না পায় যে ওখানে সুপারন্যাচুরাল কিছু আছে বা থাকতে পারে আর সেটা সারাতেই আমাকে আনা, তাতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি তাই এই পরিচয় গোপন,ডিনারের টেবিলে দেখলাম এক   অপরিচিত যুবক, শেরিফ আলাপ করিয়ে দিলেন, “এ হলো চার্লস, আমাদেরই এক জুনিয়ার অফিসার,আমি তো কাজ থাকার দরুন তোমার সাথে যেতে পারবোনা, এই তোমাকে সব ঘুরে দেখিয়ে দেবে”, বলে শেরিফ আমার দিকে চোখের ইশারা করলেন, আমিও মৃদু হেসে চার্লসের দিকে সম্মতি জানালাম।

#পাঁচ
গোটা সকালটা কাটলো বিভিন্ন ফাইল দেখে, সবই ঐ বাড়ি সম্পর্কিত।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে গেল, সন্ধ্যে হওয়ার মুখে চার্লস এলেন।
জায়গাটা এখান থেকে বেশ খানিকটা দূর, ঠিক হল একটু রাত হলে যখন প্রায় গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে যাবে, তখন আমরা গোপনে বাড়িতে প্রবেশ করব।
বাকী জনপদ থেকে বেশ খানিকটা তফাতে, একটা ছোট্ট টিলার ওপর বাড়িটা ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে একা।
শেরিফ আমাদের ছাড়তে এলেন, যাওয়ার সময় আমার হাতদুটো ধরে বললেন,তোমাদের একা এভাবে ছাড়তে আমার একদম ভালো লাগছেনা, কিন্তু বাবা বুঝতেই পারছ,বয়স হয়ে গেছে রাতেও ভালো দেখিনা আর আমি এখানে রাত কাটালে সেই গ্রামের মধ্যে একটা গুঞ্জন পড়ে যাবে,শেরিফের কথা শুনে আমার মনে মনে বেশ মজা লাগছিলো, বৃদ্ধ বেশ ভয় পেয়েছেন বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু সেটা ঢাকা দিতে বেশ আভিজাত্যের সাথে চালিয়াতি করে যাচ্ছেন বেশ, আমি মুখে বললাম, “আপনি ভাববেন না, আমার এসবে অভ্যাস আছে, আপনি ভোরে এসে খবর নিয়ে যাবেন, কিচ্ছু হবেনা আমাদের”
- বেশ বেশ, তবে ভাবনার বেশী কিছু নেই, এই চার্লস খুব সাহসী ছেলে দু হাতে বন্ধুক ছুঁড়তে পারে, ওই জন্য ওকে দিলাম তোমার সাথে, তাহলে আমি এখন যাই, কাল আসব ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে এখনকার মত কষ্ট করে হাঁটতে হবেনা তোমাদের, চলে গেলেন শেরিফ।
এক হাতে হাতে চাবির গোছা আর এক হাতে টর্চ নিয়ে চার্লস এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে, আমিও যোগ দিলাম।
দেখতে দেখতে ঘণ্টাখানেক কেটে গেলো ,দোতলার একটা ঘরে আমরা গুছিয়ে নিয়েছি একটু,একটা কাপড় পেতে চার্লস আরামসে ঘুম দিচ্ছে একটা খাটে, আর আমি একটা সোফাতে বসে গল্পের বই পড়ছি একটা।
বেশ একটা ঝিমুনি মতন এসে গেছিলো, হঠাৎ শুনি চিল চিৎকার, দেখলাম চার্লস খাট থেকে ছিটকে নীচে পড়ে গেছে, আর চিৎকার করে যাচ্ছে পাগলের মত, আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে চার্লস,কিন্তু স্পষ্ট কোনও কথাই বের হচ্ছেনা ওর মুখ দিয়ে, শুধু আঙ্গুল দিয়ে খাটের দিকে ইশারা করে চিৎকার করে যাচ্ছে, আমি খাটের দিকে তাকালাম এবার,তাজ্জব হয়ে গেলাম ,সেই আগের পুরানো নোংরা ঝুলওয়ালা খাট আর নেই,সেখানে তখন  সুসজ্জিৎ রীতিমত বিলাসবহুল এক খাট , আর তার মধ্যে জড়াজড়ি শুয়ে আছে দুটো নগ্ন শরীর, এক মেম আর এক নিগ্রো,হঠাৎ কোথা থেকে এক বুড়ো সাহেব এসে একটা শাবল দিয়ে আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগলো তাদের ওপর,রক্তের ফোয়ারা ছুটল,সাদা বিছানা ভিজে লাল হয়ে গেলো, আর কি বীভৎস দুটো মানুষের মৃত্যু-যন্ত্রণার চিৎকার, আমি বিমুড় হয়ে দেখে যেতে লাগলাম।
তারপর হঠাৎ সাহেবটা থেমে গেলো,  হাতের রক্তমাখা শাবলটা নিয়ে একটু একটু করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো,এবারে আমার সম্বিত ফিরে এলো, দৌড়ে গিয়ে বাক্স থেকে একটা বড় ক্রুশ নিয়ে এলাম,একহাতে চার্লসকে ধরে আর এক হাতে ক্রুশ ধরে রইলাম শক্ত করে।
সাহেবটা থেমে গেল, আর তারপরে আমাদের তাকিয়ে বিকট ভঙ্গিতে হাসতে থাকল, হঠাৎ দেখি সে সেইভাবেই চিৎকার করে হাসতে হাসতে দোতলার ভাঙ্গা জানলাটা দিয়ে সোজা নীচে লাফিয়ে পড়ল।
ঘটনার আকস্মিকতায় কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানিনা,একটা গোঁ গোঁ শব্দে যখন হুঁশ ফিরল দেখলাম, চার্লস অজ্ঞান হয়ে গেছে। মনে মনে এক চোট গালাগাল করলাম শেরিফ থমাসকে, এত ‘সাহসী’ একটা লোককে আমার সাথে গছিয়ে দেওয়ার জন্য।
যাইহোক চার্লসকে টেনে নিয়ে এসে সোফায় শুইয়ে দিলাম,ঘড়ির দিকে তাকালাম সবে একটা, ভোর হতে এখনও অনেক রাত, কি যে করি, নাহ ফাদারের কথায় উৎসাহিত হয়ে এভাবে প্রথমেই একা একা চলে আসা উচিৎ হয়নি।
একটা কাজ সেরে নিলাম এর মধ্যে, আমার বাক্সে সিলভার আর জেরুজালেমের পবিত্র বালি মেশানো একটা মিশ্রণ ছিল, সেটাকে গোল করে সোফার চারদিকে ছড়িয়ে দিলাম, এটা ভেদ করে কোনও শক্তি এসে আমাদের কোনও ক্ষতি অন্তত করতে পারবেনা, রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দিতে হবে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম ঘরের মধ্যে একটা রেকর্ড বাজতে শুরু করেছে, সেই Gloomy Sunday,উফ ঈশ্বর আবার যে কি অপেক্ষা করে আছে কে জানে।
দেখলাম ঘরের মাঝে সেই খাটটা আর নেই, সে জায়গায় একটা টেবিল আর চেয়ার এসে গেছে , আর তাতে বসে এক কমবয়সী সাহেব মদ খেয়ে যাচ্ছে,তার গায়ে পুলিশের পোশাক, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার দিকে তাকিয়ে ঠিক একইভাবে হাসতে শুরু করল,কি বিকট সেই হাসি, আমি আর পারলাম না কান দুটো চেপে ধরলাম।
হাসতে হাসতেই সে পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে আনলো, আর তারপরই সোজা মাথায় ধরে ট্রিগার টিপে দিলো , ছিটকে এলো রক্ত ঘিলু,আমি দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দিলাম , আমার সারা গা ভিজে গেল সে রক্তে,আমার পা দুটো আর নিতে পারলনা,ধপ করে বসে পড়লাম।
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানিনা,যখন মুখ থেকে হাত সরালাম দেখলাম কই ঘরে তো কিচ্ছু নেই,আর আমার গায়েও কোনও রক্তের দাগও নেই,উফফ জানিনা কখন এ যন্ত্রণা শেষ হবে, ঘড়িতে দেখলাম সবে ২.৩০।
- সোম সোম, শুনতে পাচ্ছো, আমি এসেছি, দেখো, শুধু তোমার জন্য এসেছি,ধড়ফড় করে আমি উঠে বসলাম, কখন চোখ লেগে গেছিল কে জানে,চার্লসের দিকে তাকালাম, সে তখনও দেখলাম অজ্ঞান, তাহলে কে ডাকলো আমাকে? কিন্তু স্পষ্ট আমি শুনেছি কেউ ডেকেছে আমাকে।
- ভালো করে দেখো সোম, আমি এসেছি শুধু তোমার জন্যই,মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল, এই গলার আওয়াজ চিনি আমি, মায়া , মায়া এসছে, কিন্তু সেটা কিকরে সম্ভব?
- আমি কিন্তু তোমাকে ভালবেসেছিলাম সোম,দুনিয়ার সমস্ত আনন্দ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার পাদ্রীসাহেব আমাদের আলাদা করে দিলো।আজ এসো সোম সব বন্ধন ছেড়ে আমরা আবার মিলিত হই চিরতরে।
বুঝতে পারলাম,বাইরে থেকে মায়া ডাকছে আমাকে,আর এটাও বুঝতে পারলাম নিজের শরীরের ওপর আমার আর কোনও বশ নেই, তাই সমূহ বিপদ জেনেও আমি সেই গণ্ডী ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম সেই ভাঙ্গা জানলার দিকে,মায়ার সাথে আমাকে দেখা করতে হবেই, অনেক কথা বলার আছে ওকে আমার।
মায়া, মায়া, তুমি কোথায়? চিৎকার করে আমি সেই গরাদভাঙা জানলা দিয়ে নীচে লাফিয়ে পড়বার উপক্রম করছি, হঠাৎ কে যেন সোম বলে একটানে  আমাকে জানলা থেকে নীচে নামিয়ে আনলো।
- তারপর ? তারপর কি হল প্রফেসর?আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
- তারপর, তারপর আর কি, একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস নিলেন তিনি, তারপর বললেন, সকালে যখন ঘুম ভাঙল, দেখলাম আমি শেরিফ থমাসের বাড়িতে শুয়ে আছি,আমাকে ঘিরে অনেক লোক,ফাদার জোসেফও, চোখে জল নিয়ে তিনি দেখলাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আমাকে ক্ষমা করো My Son, এভাবে তোমাকে শুরুতেই একা একা পাঠানো উচিৎ হয়নি, পরমপিতার অসীম করুণা যে তোমাকে আমরা আবার ফেরত পেয়েছি।
- কিন্তু ফাদার বাড়ীটার কি হবে,আর ঐ বাড়িতে যা ঘটছে তার কি হবে?
- তুমি ওসব নিয়ে কিচ্ছু ভেবনা, আমি লোক পাঠিয়ে দিয়েছি যা আচার-অনুস্থান করার ওরা করে নেবে, তুমি বিশ্রাম নাও।
-আর চার্লসের কি হল? আমি প্রশ্ন করি
- ওহ তোমাকে তো একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি কৌশিক।
- কি?
-চার্লসকে পরের দিন যখন ধন্যবাদ জানাতে গেলাম, আমার প্রান বাঁচানোর জন্য, সে তো দেখি  লজ্জায় আমার চোখের দিকে তাকাতেই পারছেনা।
- মানে ?
- মানে আবার কি, সে রাতে হাত ধরে হ্যাঁচকা টেনে চার্লস আমাকে বাঁচায়নি
- তাহলে কে বাঁচিয়েছে ?
-আমি কি জানি, তুমি গপ্প লেখো তুমি ভেবে নাও, শুধু এটা বলতে পারি, পরে যখন ঠাণ্ডা মাথায় আগের সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে করেছি, মনে পড়েছে শেষে যখন হ্যাঁচকা টানটা খেয়েছিলাম, তখন সোম বলে যে ডাকটা শুনেছিলাম সেটা একটা বাঙ্গালী লোকের গলা ছিল
- মানে? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
- ভাবো বাঙ্গালী ভাবো, ভাবাটা প্র্যাকটিস করো, আমি যাই একটু অবিনাশকে দেখে আসি, অনেকক্ষণ একা আছে বেচারী।
আমাকে হতবাক করে দিয়ে,হো হো করে অট্টহাসিতে ঘর মাতিয়ে, বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর সোম, আমি বসে রইলাম বোকার মত.........।।

      
 










          





            


You Might Also Like

1 comments